মানচিত্রের প্রকারভেদ

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - ভূগোল ও পরিবেশ - মানচিত্র পঠন ও ব্যবহার | NCTB BOOK

মানচিত্র অনেক প্রকার হতে পারে। সাধারণত মানচিত্রে ব্যবহৃত স্কেল এবং বিষয়বস্তু অনুসারে মানচিত্রগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। স্কেল অনুসারে মানচিত্র আবার দুই প্রকারের-

(ক) বৃহৎ স্কেলের মানচিত্র এবং

(খ) ক্ষুদ্র ভেলের মানচিত্র।

নৌচলাচল সংক্রান্ত নাবিকদের চার্ট, বিমানচলাচল সংক্রান্ত বৈমানিকদের চার্ট, মৌজা মানচিত্র বা ক্যাডাস্ট্রাল মানচিত্র প্রভৃতি বৃহৎ স্কেলের মানচিত্র। একটি ছোট এলাকা অনেক বড় করে দেখানো হয় বলে মানচিত্রের মধ্যে অনেক জায়গা থাকে এবং অনেক কিছু তথ্য এরূপ মানচিত্রে ভালোভাবে দেখানো যায়। ভূচিত্রাবলি মানচিত্র, দেয়াল মানচিত্র প্রভৃতি ক্ষুদ্র স্কেলের মানচিত্র। সমগ্র পৃথিবী বা মহাদেশ বা দেশের মতো বড় অঞ্চলকে একটি ছোট কাগজে দেখানো হয় বলে এ প্রকার মানচিত্রে বেশি জায়গা থাকে না। ফলে এ মানচিত্রে বেশি কিছু দেখানো যায় না।

উপস্থাপিত বিষয়বস্তু হিসেবেও মানচিত্রগুলো দুই প্রকারের- (ক) গুণগত মানচিত্র এবং (খ) পরিমাণগত মানচিত্র।

(ক) গুণগত মানচিত্র ভূতাত্ত্বিক মানচিত্র, ভূসংস্থানিক মানচিত্র, ভূমিরূপের মানচিত্র, মৃত্তিকা মানচিত্র, দেয়াল মানচিত্র, ভূচিত্রাবলি মানচিত্র, স্থানীয় বৈচিত্র্যসূচক মানচিত্র এবং মৌজা মানচিত্র গুণগত মানচিত্রের অন্তর্গত।

(খ) পরিমাণগত মানচিত্র বায়ুর উত্তাপ, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ, জনসংখ্যার বণ্টন, জনসংখ্যার ঘনত্ব, খনিজ উৎপাদন, বনজ উৎপাদন, শিল্পজ উৎপাদন প্রভৃতি পরিসংখ্যান তথ্য যেসব মানচিত্রে দেখানো হয় সেসব মানচিত্র পরিমাণগত মানচিত্রের অন্তর্গত। কার্যের উপর ভিত্তি করে কয়েক প্রকার মানচিত্র নিম্নরূপ :

১। ক্যাডাস্ট্রাল বা মৌজা মানচিত্র (Cadastral or Mouza map)ঃ ক্যাডাস্ট্রাল শব্দটি এসেছে ফ্রেঞ্চ শব্দ ক্যাডাস্ট্রে (Cadastre) থেকে, যার অর্থ হচ্ছে রেজিস্ট্রিকৃত নিজের সম্পত্তি। এই মানচিত্র তৈরি করা হয় সাধারণত কোনো রেজিস্ট্রিকৃত ভূমি অথবা বিল্ডিং-এর মালিকানার সীমানা চিহ্নিত করার জন্য। আমাদের দেশে আমরা যে মৌজা মানচিত্রগুলো দেখতে পাই সেগুলো আসলে ক্যাডাস্ট্রাল মানচিত্র। এই মানচিত্রের মাধ্যমেই হিসাব করে সরকার ভূমির মালিক থেকে কর নিয়ে থাকে। এই মানচিত্র সবচেয়ে বড় ।

এই মানচিত্রে নিখুঁতভাবে সীমানা দেওয়া থাকে। এই মানচিত্রগুলো বৃহৎ স্কেলে অঙ্কন করা হয়, যা ১৬ ইঞ্চিতে ১ মাইল বা ৩২ ইঞ্চিতে  ১ মাইল। এই ধরনের মানচিত্রের মধ্যে বিবিধ তথ্য প্রকাশ করা হয়। শহরের পরিকল্পনার মানচিত্রও এই মৌজা মানচিত্রের অন্তর্ভুক্ত ।

২। সানিক মানচিত্র (Topographic map)ঃ সংস্থানিক- এর আরেক নাম হচ্ছে স্থানীয় বৈচিত্র্যাসূচক মানচিত্র। এই মানচিত্রগুলো প্রকৃত জরিপকার্যের মাধ্যমে প্রস্তুত করা হয়। সাধারণত এর মধ্যে প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক দুই ধরনের উপাদান দেখতে পাওয়া যায়। এই ধরনের মানচিত্রের খেল একেবারে ছোট না হলেও মেজা মানচিত্রের মতো বৃহৎও নয়। এই মানচিত্রগুলোতে কিন্তু জমির সীমানা দেখানো হয় না। ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে পাহাড়, মালভূমি, সমভূমি, নদী উপতাকা, হ্রদ প্রভৃতি দেখানো হয়। অন্যদিকে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য হিসেবে রেলপথ, হাটবাজার, পোস্ট অফিস, সরকারি অফিস, খেলার মাঠ, মসজিদ, মন্দির প্রভৃতি নিখুঁতভাবে লেখানো হয় । বর্তমান যুগে বিমান থেকে ছবি তোলার মাধ্যমে এই মানচিত্রের নবযুগের সূচনা হয়। এই মানচিত্রের স্কেল ১:২০,০০০ হলে ভালোভাবে বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকাশ পায়।

বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন স্কেলে এই মানচিত্র তৈরি করে। সবচেয়ে আদর্শ ও জনপ্রিয় হচ্ছে ব্রিটিশদের তৈরি করা মানচিত্র যার ফেল ছিল ১:২৫,০০০ থেকে ১:১০০,০০০ এবং আমেরিকাতে এই মানচিত্রের স্কেল থাকে সাধারণত ১:৬২,৫০০ এবং ১:১২৫,০০০। বাংলাদেশ সাধারণত ব্রিটিশ স্কেলটি অনুসরণ করে।  

৩। দেৱান মানচিত্র (Wall map)ঃ লেয়াল মানচিত্র তৈরি করা হয় সাধারণত শ্রেণিকক্ষে ব্যবহার করার জন্য। সারা বিশ্বকে অথবা কোনো গোলার্ধকে এই মানচিত্রের মধ্যে প্রকাশ করা হয়। দেয়াল মানচিত্রে আমাদের চাহিদা মতো একটি দেশ অথবা একেকটি মহাদেশকে আলাদাভাবে প্রকাশ করা হয় বড় অথবা ছোট ফেলে (চিত্র ৩.৫)। এই দেয়াল মানচিত্রের স্কেল ভূসংস্থানিক মানচিত্রের চেয়ে ছোট কিন্তু ভূচিত্ৰাৰণি মানচিত্রের চেয়ে বড়।

৪। ভূচিত্রাবলি বা এটলাস মানচিত্র (Chorographical or Atlas map)ঃ মানচিত্রের সমষ্টিকে ভূচিত্রাবলি (এটলাস) বলে। এই মানচিত্রকে সাধারণত খুব ছোট ফেলে করা হয়। এটি প্রাকৃতিক বাত এবং অর্থনৈতিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ভাগ করে তৈরি করা হয়। বেশিরভাগ ভূচিত্রাবলি মানচিত্রে স্থানের অভাবে রং দিয়ে বৈশিষ্ট্য বোঝানো হয়। শুধু পাহাড়ের চূড়া, পুরত্বেপূর্ণ নদী এবং রেলওয়ের প্রধান রাস্তা বোঝানোর জন্য প্রতীক দেওয়া থাকে। কিছু কিছু চিত্রাবনি করা হয় ১:১০০০,০০০ স্কেলে। আমাদের দেশে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এই মানচিত্র তৈরি করে থাকে। এই মানচিত্রে সমগ্র পৃথিবীকে একটি পৃষ্ঠার মধ্যে দেখিয়ে থাকে। বাংলাদেশকেও ঐ একটি পৃষ্ঠার মধ্যে জেলাগুলো ইত্যাদি দেখিয়ে থাকে। এতে প্রাকৃতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও কৃষিভিত্তিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে মানচিত্র তৈরি করা হয়।

৫। প্রাকৃতিক মানচিত্র (Physical map): যে মানচিত্রে কোনো দেশ বা অঞ্চলের বিভিন্ন প্রাকৃতিক ভূমিরূপ যেমন- পর্বত, মালভূমি, ভূমি, নদী, হ্রদ ইত্যানি সম্পর্কে তথ্য থাকে তাকে প্রাকৃতিক মানচিত্র বলে।

৬। ভূতাত্ত্বিক মানচিত্র (Geological map): গঠনকারী বিলাসমূহের অবস্থান ও গঠনের উপর তিনি করে এই ধরনের মানচিত্র তৈরি করা হয়।

৭। জলবায়ুপত মানচিত্র (Climatic map):  বাহুর তাপ, বায়ুর চাপ, বায়ুপ্রবাহ, বৃষ্টিপাত, আর্দ্রতা প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে যে মানচিত্র তৈরি করা হয় তাকে জলবায়ুগত মানচিত্র বলে।

৮। উদ্ভিজ বিষয়ক মানচিত্র  (Vegetation map) : বিশ্বের কোথায় কোন ধরনের প্রাকৃতিক উদ্ভিদ আছে তার উপর ভিত্তি করে যে মানচিত্র তৈরি করা হয় তাকে উদ্ভিদ বিষয়ক মানচিত্র বলে।

৯। মৃত্তিকা বিষয়ক মানচিত্র (Boll map):  বিশ্বের কোথায় কোন ধরনের মাটি তার উপর ভিত্তি করে এই মানচিত্র তৈরি করা হয়। সাধারণত মাটির গুণাগুণের উপর ভিত্তি করেই বিশ্বের কোথায় কোন ধরনের ফসলের চাষ করা যাবে সেজন্য কৃষিবিদরা এই ধরনের মানচিত্র বেশি ব্যবহার করে থাকেন।

১০। সাংস্কৃতিক মানচিত্র ( Cultural map): বিভিন্ন স্থানের অর্থনৈতিক অবস্থ্য, বিভিন্ন দেশ ও রাষ্ট্রের সীমা, ঐতিহাসিক কোনো স্থান বা স্থাপত্য, পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের সমাজ ব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে যে মানচিত্র তৈরি হয় তাকে সাংস্কৃতিক মানচিত্র বলে।

আবার সাংস্কৃতিক মানচিত্রকেও কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন-

(ক) রাজনৈতিক মানচিত্র (Political map): বিভিন্ন দেশ ও রাষ্ট্রের সীমা দেখিয়ে এই মানচিত্র তৈরি করা হয়। এর মধ্যে কোনো দেশ বা রাষ্ট্রের রাজধানী ও গুরুত্বপূর্ণ শহরও দেখানো হয়।

(খ) বণ্টন মানচিত্র (Distribution map): যেসব মানচিত্রে জনসংখ্যা, শসা, জীবজন্তু, শিল্প ইত্যাদির বণ্টন কোনো একটি অঞ্চল বা দেশে দেখানো হয় তাকে বণ্টন মানচিত্র বলে।

(গ) ঐতিহাসিক মানচিত্র (Historical map): ঐতিহাসিক কোনো স্থান বা স্থাপত্যকে নিয়ে যেসব মানচিত্র তৈরি করা হয় তাকে ঐতিহাসিক মানচিত্র বলে।

(ঘ) সামাজিক মানচিত্র (Social map) : পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের সমাজ ব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে মানচিত্রগুলো তৈরি করা হয়। বিশেষ করে যারা সামাজিক প্রথা ও বৈষম্য, জনসংখ্যা এসব নিয়ে গবেষণা করেন তারা এ মানচিত্র ব্যবহার করেন।

(ঙ) ভূমি ব্যবহার মানচিত্র (Land use map): কোন ভূমি কী কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে বা কোন ভূমি কোন কাজে ব্যবহার করলে সবচেয়ে বেশি উপযোগী তার উপর ভিত্তি করে যে মানচিত্র তৈরি করা হয় তাকে ভূমি ব্যবহার মানচিত্র  বলে। 

Content updated By
Promotion